লেখকঃ প্রান্তিক সৌরভ
খুব ভোর।
আকাশ কালো করে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। জবাপাতার সবুজী অহংকারী বুকে বৃষ্টির ফোটারা ভেঙেচুড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
আমি দাড়িয়ে আছি একটি বেগুনী ছাতার নিচে।
আর আমার সামনে মেয়েটি।
ছাতার বাইরে। ঠোঁটগুলো তার মৃদু মৃদু কাঁপছে। এখন এই ঠোঁট কাপার কারণ কি বৃষ্টির শীতলতা নাকি বুকের ভেতরকার জমাট বাধা কান্নার উত্থালপাথাল ঢেউ-তা আমার এখনো পুরোপুরি বোধগম্য হচ্ছে না। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম,”তুমি ছাতার নিচে আসো।”
মেয়েটি বললল,”তুমি কি অন্য কাউকে ভালবাসো?”
“না।”
“তাহলে?”
“ঐ ভালবাসা-বাসি আমার দ্বারা আর হবে না।”
“এতটা ঘৃণা করো আমায়!”
“তোমাকে ঘৃণা করার অনুভূতি আজ অব্দি আমার হাইপোথ্যালামাস তৈরী করতে পারেনি।”
সে কতকটা আকূল হয়ে বলল,”তুমি তো এমন ছিলে না!”
আমি মুচকি হেসে জবাব দিলাম,”তুমিও তো এমন ছিলে না।”
“আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।”
“সম্ভবত আমিও।”
সে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তাাকিয়ে আছি নিচের দিকে,যেন তার দিকে তাকালেই বুকের ভেতর কিছু একটা হয়ে যাবো। আমি আরো একবার মরে যাবো।
“তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কাঁদছি?”
“হুম।”
“এক সময়কার যে তুমি আমার চোখে-মুখে পড়ন্ত বিকেলের বিষণ্ণতা দেখলেই দিকবিদিক দিশেহারা হয়ে পড়তে সেই তোমারই সামনে আজ আমি কাঁদছি,আর তুমি কিনা…!”
“জানো কি মিহির,”একটা সময়কার সেই ‘আমি’ আর আজকের ‘আমি’র মধ্য দিয়ে বিশাল এক স্রোতস্বিনী নদী বয়ে গেছে। সে নদীর জোয়ার-ভাটার খেলায় অনেক কিছু বদলে গেছে। অনেক অনেক প্রাণবন্ত দ্বীপ ভেঙেচুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেদিনকার সেই ‘আমি’র অস্তিত্ব আজ আর নেই মিহির। ঐ আমির স্থলে আজ শুধু রাতের মেঘনার শো শো শব্দের মতো হাহাকার।”
“কিন্তু আমি যে আজ সব হারিয়ে নিঃস্ব! আমি এখন কি করব?”
“তুমি বরং এখন বাড়ি গিয়ে গরম কাপড় পরে কড়া করে এককাপ কফি খেয়ে ফ্রেশ একটা ঘুম দাও। দেখবে পরের সকালটায় সবকিছু বদলে গেছে।”
“আমি মরে যাবো ব্যস্।”
“মৃত্যু এত সহজ না মিহির।”
“তুমি একটা পাথর।”
“এটা সময়োপযোগী।”
“কিন্তু তোমাকে ছাড়া যে আমার চলবে না!”
“হাটের দোকানে লাভের ব্যবসা করে সন্ধ্যার চূড়ান্ত সীমানায় এসে সবসময়ই যে শেষের ট্রেনটা পেয়ে যাবে-এমন তো কোনো কথা নেই মিহির।”
হঠাৎ করেরে চারদিকে ছন্নছাড়া নীরবতা নেমে এলো। যেন ঝরা বৃষ্টিও টুপ করে গম্ভীর হয়ে গেল।
বৃষ্টি বাড়ছে।
সেই সাথে বেলাও।
“তুমি বাড়ি চলে যাও মিহির।”
মিহির কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,”তোমাকে কি শেষবারের মতো একটাবার জড়িয়ে ধরতে পারি?”
“উহু,তুমি যে পুরোপুরি ভিজে গেছ,এখন আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমিও যে ভিজে যাবো!”
দুচোখে ভীষণ অবাক হয়ে মিহির আমার দিকে তাকালো। এপর্যায়ে আমিও তাকালাম ওর দিকে। একবারে চোখের দিকে। তারপর শীতল গলায় বললাম,”একটা সময় যখন শুকনো ছিলে তখন ছাতার নিচে এসে পাশাপাশি দাড়াতে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি সাড়া দাও নি। সময়ের কাজ সময়ে করে নিতে হয় মিহির। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে আগের জায়গায় ফিরে এলেও সময় কিন্তু কখনো আগের জায়গায় ফিরে আসে না। বরং বদলে যায় এবং বদলে যেতে থাকে। তুমি এখন আর আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারো না।”
.
ভেবেছিলাম শেষোক্ত কথাগুলোর মর্মার্থ মিহির ধরতে পারবে না।
কিন্তু না।
সে আজ আমার প্রতিটি কথার অর্থ বর্ণে বর্ণে বুঝে গেছে।
তাইতো আর কোনো প্রত্যুত্তর করেনি। নিঃশব্দে হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে দারুণ কান্নায় ভেঙে পড়ল।
.
আমি আর দাড়িয়ে থাকি নি। ঘুরে হাঁটা দিয়েছি বাড়ির পথে।
বৃষ্টি পড়ছে আগের মতোই।
আমি হাঁটছি আর ভাবছি।
যাওয়ার পথে রাজুর দোকান থেকে একটা বলপয়েন্ট কলম কিনে নিয়ে যেতে হবে। ট্রাঙ্ক থেকে আজ ডায়েরীটা বের করব।
অনেকদিন পর।
অনেকদিন পর আজ ডায়েরীতে আবেগের ঝর উঠবে। কেেউ কাঁদবে না,শুধু কলমের কালিগুলো লেপ্টে যাবে ডায়েরীর পাতায় পাতায়।
.
একটা সময় যাকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসে স্রেফ বিক্রি হয়ে যেতে চেয়েছিলাম তার হাটে,সেই তাকেই আজ এতটা নিষ্ঠুরভাবে ফিরিয়ে দিলাম!
এমুহূর্তে যতটা পৈশাচিক আনন্দ পাবার কথা ছিল তার বিন্দুমাত্রও আমার মধ্যে খেলা করছে না। অনুভূতিরা আমার বড্ড নিথর আছে। সূর্যের প্রথম আলোয় প্রস্ফুটিত সত্যিকারের ভালবাসার গুরুত্ব যে দেয় নি তার পরিণতি এভাবেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়য়ে মাটিতে মিলিয়ে যাবে-এটাই স্বাভাবিক। এবং এ স্বাভাবিক ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছে আমার হৃদয়। তাইতো হৃদয়ের কোথাও হৃদস্পন্দনের উত্থালপাথাল নেই। নেই কোথাও উন্মত্ত হাহাকার।
শুধু বুকের বামপাশটায় কেমন যেন চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে।
বোধ করি ওটাই ভালবাসার সর্বশেষ ধ্বংসাবশেষ।
এবং ঐ ভালবাসাটাই আমার প্রাণেরও সর্বশেষ ধ্বংসাবশেষ।
.
ভালো থেকো মিহির।
সত্যি বলছি,ডায়েরীর পাতায় পাতায় আজও শুধু তোমাকেই ভালবাসি….
০ Comments